This is this sidebar for a particular page. It can be edited by editing a page from within the control pannel.
বাইবেলের পুরাতন নিয়মের আদিপুস্তকে নোহ এবং বন্যার গল্পটি হচ্ছে সবচেয়ে পরিচিত একটি ঘটনা যা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে কল্পনায় আঁকড়ে ধরেছে। এই গল্প যতটা চমৎকার, ততটাই রহস্য দিয়ে ঘেরা। লক্ষ লক্ষ কিংবা হাজার বছর পূর্বে কি আদৌ পৃথিবীর পুরো ভূখণ্ড বন্যায় ডুবে গিয়েছিল? বন্যা হলেও তা কি ছিল কেবল আঞ্চলিক বন্যা নাকি তা হয়েছিল পুরো বিশ্বব্যাপী? কেনই বা এত বিশাল বন্যা আঘাত হানে পৃথিবীতে? সৃষ্টিকর্তাই বা কেনো মানুষকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন কেবলমাত্র নোহের পরিবার ছাড়া?
বন্যার প্রেক্ষাপটঃ
পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কে ঘাটালে বিভিন্ন অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েবসাইটে দেখা যায় বাইবেলে নোহের সময়কার বন্যার ঘটনা ছাড়াও প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় (সুমেরীয় ও আক্কাদিয়ান ঐতিহ্য একত্রে) এরকম বন্যার প্রধান তিনটি বর্ণনা রেখে গিয়েছে; এদের নাম “এরিদু জেনেসিস” , “এপিক অব গিল্গামেস” এবং “আত্রা-হাসিস”। এছাড়াও “সুমেরীয় রাজাদের তালিকা” নামের প্রাচীন লিখিত সাহিত্যের মধ্যেও এরকম বিশেষ বন্যার কথা উল্লেখ করা রয়েছে। বেশ কিছু সেকুলার, সাহিত্যবিদ এবং ক্রিটিকাল স্কলারদের মধ্যেও একটি মতবাদ প্রচলিত ছিল এবং এখনো আছে যে নোহের সময়কার বন্যার গল্পের সাথে এই মেসোপটেমিয়ান বন্যার কাহিনির মিল পাওয়া যায় এবং সম্ভাবনা রয়েছে এই গল্পগুলো একে অপরের থেকে ধার করা।
আদিপুস্তক পড়লে দেখা যায় নোহের সময়কার বন্যা ঘটানোর সৃষ্টিকর্তার যেই উদ্দেশ্য ছিল সেটির সাথে অন্য প্যাগান পৌরাণিক দেবতাদের চিন্তাধারা খাটে না। এমনকি বিশেষ বিশেষ কিছু অংশেও এদের বর্ণনা করার ধরন এবং মতবাদ অনেকটাই ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছিল। তবে একটি মূল বিষয় অবশ্যই ধারনা করা যেতে পারে এবং তা হলোঃ বন্যার সত্যতা বিভিন্ন রুপক ও সুপরিচিত ব্যক্তিদের সংযোজনে বর্ণনা করা হয় যা প্রাথমিকভাবে এই বন্যার ঐতিহাসিকতাকে সমর্থন করে। বাইবেলে বর্ণিত এই বন্যার হাত থেকে কেন নোহের পরিবারকে ঈশ্বর বাঁচিয়ে রাখেন? পরবর্তীতে এই পরিবারকে তিনি কিভাবে ব্যবহার করবেন? এই বন্যার উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে আদিপুস্তকের ৬ অধ্যায়ে।
মঞ্চ গঠনঃ পাপের সমস্যা ও ঈশ্বরের বিচার
পৃথিবীতে মানবজীবন যখন বিস্তার করতে থাকে ঠিক এমন এক সময়ে মেয়ে সন্তান জন্মের সংখ্যা বেড়ে যায়। “ঈশ্বরের সন্তানেরা” এই মেয়েদের সুন্দরী দেখে যার যাকে ইচ্ছা তাকেই বিয়ে করতে লাগল। ঈশ্বরের সন্তানদের সাথে এই মেয়েদের মিলনের ফলে যে সন্তানদের জন্ম হল তারা ছিল পুরানো দিনের নাম-করা শক্তিশালী লোক। সেই সময় এবং তার পরেও পৃথিবীতে নেফিলীয় নামে এক জাতের লোক ছিল। এরকম সময়ে ঈশ্বর মানবজাতিকে সঠিক পথে জীবন যাপন করার জন্য আরও ১২০ বছর সময় দেন (আদি ৬ঃ১-৪)।
কিন্তু মানুষ তার নিজের মন্দতার পরাধীনতাকে স্বাধীনতা ভেবে নিজেদের ইচ্ছা-খুশি বাস করতে থাকে। তাদের আচরনের সূক্ষ্ম বিবরন আদিপুস্তকে প্রকাশ না পেলেও এসময়ে ঈশ্বরের মন সম্পর্কে আমরা জানতে পারি; সৃষ্টিকর্তা দেখলেন পৃথিবীতে মানুষের দুষ্টতা খুবই বেড়ে গেছে, আর তার অন্তরের সব চিন্তা-ভাবনা সব সময়ই কেবল মন্দের দিকে ঝুঁকে আছে। এতে তিনি অন্তরে ব্যথা পেলেন এবং পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলে দুঃখিত হয়ে বললেন, “আমার সৃষ্ট মানুষকে আমি পৃথিবীর উপর থেকে মুছে ফেলব; আর তার সাথে সমস্ত জীবজন্তু, বুকে-হাঁটা প্রাণী ও আকাশের পাখীও মুছে ফেলব। এই সব সৃষ্টি করেছি বলে আমার মনে কষ্ট হচ্ছে” (আদি ৬ঃ৫-৭)। ভেবে দেখুন মানবজাতি তার মন্দতার কারণে কতটা কলুষিত হয়েছে যার ফলে সৃষ্টিকর্তা নিজেই তার সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে চান। সেই সময় ঈশ্বরের কাছে গোটা দুনিয়াটাই পাপের দুর্গন্ধে এবং অত্যাচার-অবিচারে ভরে উঠেছিল। ঈশ্বর জগতের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, তা দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে, কারণ দুনিয়ার মানুষের স্বভাবে পচন ধরেছে। কেবলমাত্র নোহ ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল (আদি ৬:৮,১১-১২)।
ঈশ্বর এই একমাত্র নোহের পরিবার ছাড়া সকলকে বন্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবেন এবং নোহ কিভাবে বাঁচতে পারবে ঈশ্বর সে বিষয়ে সূক্ষ্ম নির্দেশনা তাকে দেন। নোহ বাধ্য একজন বিশ্বাসীর মত ঈশ্বরের নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছু করেন জাহাজ নির্মাণ থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রাণীদের জোড়ায় জোড়ায় জাহাজে তোলা। নোহের বয়স যখন ৬০০ বছর চলছিল, সেই বছরের দ্বিতীয় মাসের সতেরো দিনের দিন মাটির নীচের সমস্ত জল হঠাৎ বের হয়ে আসে আর আকাশেও ফাটল ধরে, চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত ধরে পৃথিবীর উপরে বৃষ্টি পড়ে এবং পৃথিবী একশো পঞ্চাশ দিন জলে ডুবে রয়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মানবজাতি। ঈশ্বর পবিত্রতার জন্য কি করতে পারেন সেটার এক জ্বলন্ত উদাহরন এই ঘটনাটি।
নোহের ৬০১ বছর বয়সে বন্যার পানি কমে যায়। পুনরায় তারা জমিতে ফিরে আসে এবং তারপর নোহ ঈশ্বরের উদ্দেশে একটা বেদী তৈরী করলেন, প্রত্যেক জাতের শুচি পশু ও পাখী থেকে কয়েকটা নিয়ে সেই বেদীর উপরে পোড়ানো-উৎসর্গের অনুষ্ঠান করলেন। ঈশ্বর তার উৎসর্গে খুশি হন।
ঈশ্বর নোহ ও তার ছেলেদের আশীর্বাদ করেন যাতে তারা পৃথিবী ভরে তুলতে পারে। আদমকে সৃষ্টি করার পর ঈশ্বর তাকে যেই আশীর্বাদ করেন ঠিক তেমনটাই এখানে দেখা যায়। এছাড়াও ঈশ্বর নোহকে ও তার পরিবারকে জমির ফসল ও প্রাণীকে খাবার হিসেবে দেন।
ঈশ্বরের চুক্তি: নোহ ও সকল জীবজন্তু
বাইবেলে প্রথম “ব্যবস্থা/নিয়ম/চুক্তি” শব্দটি পাওয়া যায় আদিপুস্তকের ৬ অধ্যায়ে। ব্যবস্থা/নিয়ম/ চুক্তি শব্দটির অনুবাদ হয় হিব্রু শব্দ “בְּרִית” (বের-ইথ/ বেরিথ) থেকে। বন্যার পূর্বেই ঈশ্বর নিজেই নোহের সাথে এই চুক্তি স্থাপন করবেন বলে জানান (আদি ৬ঃ১৮)। পরবর্তীতে মহাপ্লাবন বা এই বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেয়ে ঈশ্বর নোহের কাছে তাঁর কথা রাখেন । কিন্তু এই চুক্তি আসলে কি?
সাধারণভাবে চুক্তি কেবলমাত্র একটি ধারনা নয় যা কেবল বাইবেলেই পাওয়া যায়। পূর্বের বাইবেলীয় সময়ের অন্যান্য সংস্কৃতিগুলি আন্তঃব্যক্তিক এবং সামাজিক সম্পর্কের পরিসরের ভিত্তি হিসাবে চুক্তির ধারণা ব্যবহার করেছিল। এক জাতি আরেক জাতির সাথে চুক্তির মাধ্যমে সংঘবদ্ধ ছিল। একে অপরের চুক্তি বন্ধুত্বের অঙ্গীকার হিসেবেও প্রকাশ করা হত এবং এমনকি ব্যবসায়িক চুক্তি হিসেবেও স্থাপন করা হত। রাজ্যের শাসক ও প্রজাদের মধ্যে কোনো চুক্তি থাকলে তা-ও জাতীয় সাংবিধানিক চুক্তি হিসেবেও তুলে ধরা হত। এটা আশ্চর্যজনক হওয়া উচিত নয় যে ঈশ্বর চুক্তির ধারণাটি নির্বাচন করবেন যাতে তিনি তাঁর লোকেদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন এমন একটি বিশ্বে যেখানে চুক্তি ছিল মৌলিক ধারণা।
ঈশ্বর তাঁর নির্বাচিত পরিবারকে ও পরিবারের সাথে রক্ষা পাওয়া সকল জীবজন্তুর সাথে চুক্তি করেন যে তিনি এরপরে আর কোনোদিন বন্যার মাধ্যমে মানবজাতি ও ভূখণ্ডের জীবজন্তুকে ধ্বংস করবেন না! এই চুক্তির চিহ্ন হিসেবে সৃষ্টিকর্তা আকাশে “রংধনু/ মেঘধনু/ ধনুক” বেছে নেন। মেঘের মধ্যে যখন সেই ধনুক দেখা দেবে তখন ঈশ্বর তা দেখে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর জন্য চিরস্থায়ী ব্যবস্থা বা চুক্তির কথা স্মরণে রাখবেন (আদি ৯ঃ১২-১৭)।
মানুষ একে অপরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে তা হয় ক্ষণস্থায়ী এমনকি চুক্তি ভাঙ্গারও অঢেল উদাহরন রয়েছে মানব ইতিহাসে। কিন্তু ঈশ্বর যখন মানবজাতির জন্য নোহের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন সেই চুক্তি হয় চিরকালীন চুক্তি যা তিনি কখনই ভাঙবেন না। চুক্তি স্থাপন ও পরিচালনা করার শক্তি ও পরাক্রম কেবলমাত্র তাঁরই রয়েছে।
সিরিয়ান সাধু ইসহাক বলেন, “ ঈশ্বরকে কখনও ন্যায়বান বলবেন না, যদি তিনি ন্যায়বান হতেন আমরা সকলেই নরকে যেতাম, নির্ভরতা রাখুন তাঁর অন্যায়ের উপর কেননা তা হল দয়া, ক্ষমা ও প্রেম।”